চৌধুরী মনসুর আহমদ স্মরণে শোকসভা, তিনি মানবিক গুণাবলিতে পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন
- আপলোড সময় : ১৮-০৭-২০২৫ ০১:১৮:২২ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৮-০৭-২০২৫ ০১:১৮:২২ পূর্বাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার ::
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৭৬-১৯৯৭) বিশিষ্ট ক্রীড়া ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চৌধুরী মনসুর আহমদ স্মরণে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শোকসভায় বক্তব্য রাখেন সিনিয়র আইনজীবী ও লেখক হোসেন তওফিক চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী হুমায়ুন মঞ্জুর চৌধুরী, শিক্ষাবিদ প্রফেসর পরিমল কান্তি দে, ক্রীড়া সংগঠক নাজির আহমদ চৌধুরী, প্রফেসর সৈয়দ মহিবুল ইসলাম, সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য অ্যাড. আলহাজ্ব নূরুর রব চৌধুরী।
সভা সঞ্চালনা করেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. খলিল রহমান।
এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন কবি ও অ্যাড. রবিউল লেইস রোকেশ, ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ, অ্যাড. মতিউর রহমান পীর, ক্রীড়া সংগঠক জিএম তাশহিজ, শিক্ষক আজিজুর রহমান তহুর, ব্যাংক কর্মকর্তা আশরাফ হোসেন লিটন।
সভায় বক্তারা বলেন, চৌধুরী মনসুর আহমদ ছিলেন বিশিষ্ট ক্রীড়া ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ০৪.১০.১৯৩৯খ্রিস্টাব্দে। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৪.০৬.২০২৫ খ্রিস্টাব্দে। তিনি বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।
তারা বলেন, প্রয়াত চৌধুরী মনসুর আহমেদ একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে বলে শেষ করা যাবে না।
তাঁরা বলেন, চৌধুরী মনসুর আহমদ নৈতিক সাহসিকতায় এবং মানবিক গুণাবলিতে পরিপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন। মনে হয় ১৯৬৮ সালের শেষভাগ কিংবা ৬৯ সালের প্রথম ভাগের ঘটনা হবে। পূর্ববাংলার রাজনৈতিক অবস্থা তখন উত্তপ্ত ছিল। আয়ুবশাহী পতনের দাবিতে আন্দোলন চলমান ছিল ষাটের দশক জুড়ে। এদিকে, শত্রু স¤পত্তি আইন বা এনিমি প্রপার্টি আইনের বিষাক্ত ছোবলে গ্রামেগঞ্জে ও শহরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন জর্জরিত ছিলেন। তারা ঘরবাড়ি ভিটেভাটি জমিজমা হারানোর শঙ্কায় ও আতঙ্কে দিনরাত কাটাতেন। সরকার ও প্রশাসন সন্ধ্যার পর নোটিশ জারি করে সকালে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাতেন।
বক্তারা বলেন, এহেন অবস্থায় শহরের জামাইপাড়া অঞ্চলে সবার পরিচিত ‘কাঠইরের বাসা’তে একদিন সন্ধ্যার সময় উচ্ছেদ নোটিশ জারি হয়। সকাল দশটার মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে! আমাদের প্রিয়জন ছানা দা সহ কাঠইরবাসী একধিক পরিবার বসবাস করতেন ওই বাসাতে। এই নোটিশে স্বাভাবিকভাবে ভয়ংকর আতঙ্কের সৃষ্টি হয় বাসিন্দাদের মধ্যে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা গৃহহীন হয়ে যাবেন, মাথার উপরে থাকবেনা ছাদ! এই নিদারুণ অবস্থার যন্ত্রণা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝবেনা। খবর পেয়ে মনসুর ভাইয়ের নেতৃত্বে বিশাল একদল ছাত্র আমরা জড়ো হই সেখানে। মনসুর ভাইয়ের সাফ কথা ছিল উচ্ছেদ জান দিয়ে হলেও আটকাবেন। তখন শত্রু স¤পত্তির কাষ্টডিয়ান ছিলেন ডিসি বা জেলা প্রশাসক। সুনামগঞ্জ তখন মহকুমা। সিলেট জেলার অধীনে। ডিসি থাকেন সিলেটে। তখনকার সময়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই নাজুক। কি হবে তাহলে! মনসুর ভাইয়ের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সব শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে। পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। মনসুর ভাই দৌড়াদৌড়ি করে খবর সংগ্রহ করে আনলেন যে পরের দিন ডিসি সাহেব সুনামগঞ্জ কলেজের একটি অনুষ্ঠানে বিকেলে যোগ দিতে সুনামগঞ্জ আসবেন। দেখা করার জন্য এই সুযোগটা নিতে হবে যেভাবেই হোক। পরদিন ভোর হল। সকাল দশটার দিকে ইপি সুপারিনডেন্ট পুলিশ নিয়ে এসে কিছু মালপত্র বের করে ফেলেছিল ঘর থেকে। মনসুর ভাইয়ের সঙ্গে আমরা অনেক ছাত্র ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশ কিছুটা ভড়কে যায়। তখন একটা স্থিতাবস্থা চলতে থাকে। উদ্বেগ আর আতংকে সময় কাটতে থাকে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়। কারোর নাওয়া খাওয়া নেই। ডিসি সাহেব সিলেট থেকে সুরমা নদীর উপর দিয়ে স্টিমারে করে এসে কলেজের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন এই খবর পাওয়া যায়।
বক্তারা বলেন, তখন মনসুর ভাই সবাইকে নিয়ে চলে আসেন কলেজে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। মনে হয় কলেজে তখন ইলেকট্রিক লাইন ছিলনা। পেট্রোম্যাক্স জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান চলছিল। ডি সি নিয়ে তখনকার সময়ে আমাদের ধারণা ছিল নেতিবাচক! পাকিস্তানি আমলের ডিসি! জাঁদরেল সিনিয়র সিএসপি অফিসার! ভীষণ রকমের বুরোক্র্যাট টাইপ। খাঁটি আমলা। তাছাড়া অনেকেই অবাঙালি থাকায় কথাবর্তায় সমস্যা। উনি অবশ্য বাঙালি ছিলেন। কিন্তু ডেকোরাম ভেঙ্গে উনার সঙ্গে দেখা করা যাচ্ছিলনা কোনভাবেই। আশেপাশে সবাই শহরের গণ্যমান্য লোকজন ছিলেন। তারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সুযোগ করে দিতে পারছিলেন না। কলেজে সেই সময়ে যে ক’জন শিক্ষক ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন ফিজিক্সের অধ্যাপক বিপ্রেশ চন্দ্র দত্ত মহোদয়। দত্ত স্যার এককোণে মনসুর ভাইকে ডেকে নিয়ে বলেন, মনসুর তুই ঢুকে যা ভিতরে। তখন আর কেউ কিছু বলবেনা। সাহসী ও বেপরোয়া মনসুর ভাই তখন রুমে ঢুকে একেবারে ডিসি’র সামনে চলে যান ও ঘটনার নির্মমতা তুলে ধরেন। ডিসি সাহেব কিছুটা বিচলিত হন ও কলেজ থেকে বেরিয়ে সরজমিনে ঘটনাস্থলে যাবেন মর্মে জানিয়ে দেন। আমরা সবাই চলে আসি বাসার সামনে। অনেক মানুষ ইতিমধ্যে জড়ো হন সেখানে। রাত প্রায় দশটায় ডিসি সদলবলে ঘটনাস্থলে আগমন করেন। সুনামগঞ্জ মিউনিসিপ্যালটির তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব ওবায়দুর রেজা সাহেব সঙ্গে ছিলেন। মনসুর ভাই পুনরায় ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন। তখনকার আমলাতন্ত্রের নিয়ম অনুসারে বা ট্রেনিং অনুসারে বেশিরভাগ ডিসি সাহেব শুধু শুনে যেতেন! যেন কথা বলতে ও হাসতে মানা! এদিকে ওবায়দুর রেজা সাহেবও কথা বলতেন কম! প্রতিবেশী আছদ্দর মোক্তার সাহেব তখন মনে হয় মিউনিসিপ্যালটির মেম্বার ছিলেন। তিনিও এগিয়ে আসেন। আরেক প্রতিবেশী আপ্তাব আলী বড় পেশকার সাহেব সরকারি চাকুরি করলেও তিনিও এগিয়ে আসেন। যাই হোক মনসুর ভাইয়ের শক্ত অবস্থানে এক সময়ে বরফ গলে। ডিসি মহোদয় বলে দেন উচ্ছেদ নোটিশ স্থগিত। আর এই বাসার দায়িত্ব এখন থেকে মিউনিসিপ্যালটি উপর থাকবে। বুকেচাপা পাষাণ যেন নেমে গেল! রাত প্রায় বারোটায় সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। বাসিন্দারা আগের মতো বসবাস করতে থাকেন। এভাবেই চৌধুরী মনসুর আহমদ আজীবন মানুষের উপকার করে গেছেন।
বক্তারা আরও বলেন, চৌধুরী মনসুর আহমদ ছিলেন ষাট দশকের একজন শক্তিমান কৃতীপুরুষ। তিনি শুধু একজন রাজনীতিক বা সমাজসেবকই ছিলেন না, বরং সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া এবং ছাত্র রাজনীতিতেও রেখে গেছেন অমলিন অবদান। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ পাঠাগার কর্মী। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির উন্নয়নে তার অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৪০ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক থানার ঐতিহ্যবাহী ছৈলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন চৌধুরী মনসুর আহমদ। তার পিতা ছিলেন প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মফিজ চৌধুরী। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের একজন কেন্দ্রীয় নেতা। বাচিক শিল্পে দক্ষতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতার জন্য তিনি তৎকালীন ছাত্রসমাজে ছিলেন জনপ্রিয় মুখ।
বক্তারা আরও বলেন, সুনামগঞ্জে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াঙ্গনের অগ্রসেনানী ছিলেন মনসুর আহমদ। তিনি ছিলেন আজীবন ক্রীড়াপ্রেমী, লেখক, বক্তা ও সংগঠক। সমাজসেবায় তাঁর নিষ্ঠা ও মানবিকতা অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে নতুন প্রজন্মের কাছে। সুনামগঞ্জের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ